15 Jul 2025

নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি

জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পরও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি—এমনটাই মনে করছেন আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এবং অংশগ্রহণকারী নারীরা। তাঁদের অভিযোগ, এখনো রাজনীতিতে নারীদের উপস্থিতি কেবল প্রতীকীভাবে মেনে নেওয়া হয়, মতামত ও মেধার মূল্য দেওয়া হয় না। বরং সামাজিক ও ডিজিটাল মাধ্যমে অবমাননার শিকার হতে হয় তাঁদের।

সোমবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই উইমেনস ডে শিরোনামের এক বিশেষ আয়োজনে এসব অভিযোগ করেন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা। আয়োজনে গান, চলচ্চিত্র, স্মৃতিচারণা ও ড্রোন শোর মাধ্যমে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানকে স্মরণ করা হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

অনুষ্ঠানে জুলাই অভ্যুথানের স্মৃতিচারণা করেন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীরা। এ সময় নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও এনসিপি নেত্রী নুসরাত তাবাসসুম বলেন, চব্বিশের আগেও রাজনীতি করা নারীদের যে চোখে দেখা হতো, এখনো সেই চোখে দেখা হয়। জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নারীদের ‘পলিটিক্যাল মেয়ে’ বলে আগের সরকারের আমলে ছোট করা হতো, এখনো তা করা হচ্ছে।

নুসরাত তাবাসসুম বলেন, রাজনীতিতে নারীদের শুধু মিছিলে, আন্দোলনে, ক্যামেরার সামনে দেখানোর জন্য আনা হয়। তাঁদের মেধার, তাঁদের মতামতের কোনো দাম নেই। তিনি বলেন, ‘নারীদের কথা বলার লোকও নারীরা, শ্রোতাও নারীরা, এ রকমটা তাঁরা চান না।’

এ সময় জুলাই–পরবর্তী সময়ে যেসব নারী ধর্ষিত হয়েছেন, তাঁদের কথা তুলে ধরে জুলাই আন্দোলনে আহত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া বলেন, যে গোষ্ঠী বেগম রোকেয়া, ইলা মিত্র, প্রীতিলতাকে লাঞ্ছিত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার জন্য তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন। এসব গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, দেশের সংগ্রামী নারীরা এখনো হাল ছেড়ে দেননি। যে নারীরা পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের লাঞ্ছিত করে, অপমান করে দমানো যাবে না।

জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাফসিন মেহনাজ বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার দায় রয়েছে আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারীদের কাঁধে। তাই কারও কটাক্ষ, গালি ও নেতিবাচক মন্তব্যকে আমলে নিয়ে পিছু হটা যাবে না। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থেকে নতুন 

বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার পর জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় অনুষ্ঠানটি। শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে। এরপর মঞ্চে প্রদর্শিত হয় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রযোজিত তথ্যচিত্র জুলাই উইমেন।তথ্যচিত্র প্রদর্শন শেষে বিপ্লবী গান নিয়ে মঞ্চে ওঠেন কণ্ঠশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হলে ছাতা মাথায় গান শুরু করেন তিনি। ‘জুলাইয়ের গল্প বলবো বন্ধু’, ‘এই মেয়ে শোন’, ‘আমার নাম প্যালেস্টাইন’, ‘ভয় বাংলায়’–এর মতো আন্দোলনমুখর গানগুলো পরিবেশন করেন তিনি। ‘এই মেয়ে শোন’ গান পরিবেশনের ফাঁকে তিনি বলেন, ‘মেয়েদের জন্য রাতগুলো নিরাপদ করতে হবে। এই দাবি রাখলাম।’

রাত আটটায় জুলাইয়ের স্মৃতিচারণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস। জুলাইয়ের ‘আসছে ফাগুনে আমরা হবো দ্বিগুণ’ স্লোগানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন শতগুণ, হাজার গুণ। দল থাকবে, মত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে। তবে নারীর অবমাননা আর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আবারও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যাব। কোনো দিন আর এই মাটিতে দ্বিতীয় স্বৈরাচারের আবির্ভাব হবে না।’এ সময় শহীদ নাইমা সুলতানার মা আইনুন নাহার তাঁর মেয়ের স্মৃতি তুলে ধরেন দর্শকদের সামনে। আবেগঘন পরিবেশে উঠে আসে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, প্রতিবাদ এবং ত্যাগের গল্প। এরপর রাত সাড়ে আটটায় প্রদর্শন করা হয় চলচ্চিত্র— জুলাই কন্যারা আমরা তোমাদের ভুলবো না ও জুলাই অভ্যুত্থানে চোখ হারানো মাহবুব আলমের ওপর নির্মিত একটি চলচ্চিত্র।

এরপর জুলাই অভ্যুত্থানের স্লোগানের স্মৃতিচারণা করতে মঞ্চে ওঠেন আন্দোলনে অংশ নেওয়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নারী শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাঁরা ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’, ‘এক দুই তিন চার, খুনি হাসিনা গদি ছাড়’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’, ‘দফা এক দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’, ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ প্রভৃতি স্লোগানে জুলাইয়ের স্মৃতিচারণা করেন।এরপর রাত সাড়ে নয়টায় প্রদর্শন করা হয় ছাত্রলীগের হামলায় নিহত বুয়েট শিক্ষার্থী শহীদ আবরার ফাহাদকে নিয়ে চলচ্চিত্র ইউ ফেইলড টু কিল আবরার ফাহাদ। চলচ্চিত্র প্রদর্শন শেষে কথা বলেন আবরার ফাহাদের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ। তিনি বলেন, আবরার ফাহাদকে নিয়ে এমন প্রামাণ্যচিত্র করার চেষ্টা কয়েক বছর আগেও করা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার ও ছাত্রলীগের হুমকির কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি।


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: