Tuesday, 22 July 2025

দূর্নীতির মাস্টারমাইন্ড ছিলেন শিক্ষা সচিব জুবায়ের

 

জুলাই বিপ্লবের পরও শিক্ষা খাতে বেশুমার দুর্নীতির জন্য সরাসরি দায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জুবায়েরকে অবশেষ অপসারণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বই ছাপার কাগজ কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্য, সরকারি কলেজে পদায়নে বাণিজ্য, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোয় বিভিন্ন নিয়োগে অনিয়ম ও বেশুমার দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তবে তাকে অপসারণের প্রজ্ঞাপন এই প্রতিবেদন (রাত ৯টা) লেখা পর্যন্ত জারি হয়নি। গত বছরের ১০ অক্টোবর থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের দায়িত্ব পালন করেন সিদ্দিক জুবায়ের। মঙ্গলবার তথ্য ও সম্প্রচারবিষয়ক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার অপসারণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

জানা গেছে, সোমবার রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ব্যাপক হতাহতের ঘটনায় সারা দেশ যখন শোকে স্তব্ধ, তখনই মঙ্গলবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের প্রস্তাব দেয় আন্তঃশিক্ষা বোর্ড। প্রথমে সেই প্রস্তাব নাকচ করে পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জুবায়ের। এমন সিদ্ধান্তের জেরে রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। এক পর্যায়ে রাত ২টায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেন। এই ঘটনায় গতকাল সচিবালয় ঘেরাও করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। সেখানে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। পরে সিদ্দিক জুবায়েরকে অপসারণের কথা জানান তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ‘শুধু পরীক্ষা স্থগিতের ইস্যুতে নয়, গত ১০ মাসের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল সরকার। বিশেষ করে গত বছরের বই ছাপার জন্য ৩০০ কোটি টাকার কাগজ কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্যের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া এই সচিব। এর আগেও দুই দফায় তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও সরকারের দুজন উপদেষ্টার হস্তক্ষেপের কারণে সম্ভব হয়নি।

শিক্ষা বোর্ডগুলোর আইন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ‘শিক্ষা বোর্ডগুলো বিশেষ অ্যাক্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। পরীক্ষা নেওয়া, ফল প্রকাশের জন্য তাদের সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের আমলে করা ১৯৬১ সালে অর্ডিন্যান্স সংশোধন হয় ২০২১ সালে। সেই অর্ডিন্যান্সের ধারা ২, সাব-সেকশন (২-এ) বলা হয়েছে মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সরকারের দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো অনিবার্য পরিস্থিতির কারণে ইন্টারমিডিয়েট ও সেকেন্ডারি পর্যায়ের বা এর যে কোনো পর্যায়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করা সম্ভব না হলে সেই পরীক্ষা স্থগিত করা যাবে। শুধু তাই পরীক্ষা ছাড়াই মূল্যায়ন এবং সনদ দিতে পারবে কিংবা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নিতে পারবে।’ সেই আইনি ক্ষমতা ব্যবহার করে করোনার সময় পরীক্ষা না নিয়ে অটোপাস, পরবর্তী দুই বছর সাবজেক্ট ম্যাপিং এবং অর্ধেক বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। তাহলে এবার বোর্ড কেন পরীক্ষা স্থগিত করতে পারল না—এমন প্রশ্নে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই বলতে পারবে। এত রাতে পরীক্ষা কেন স্থগিত হলো, তাও মন্ত্রণালয়কে জিজ্ঞেস করেন। আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’

দেওয়া হয়। ওইসব ক্যাডার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুই দফায় ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ আটকে যায় সিদ্দিক জুবায়েরের বাধায়। সর্বশেষ মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের পরিচালক ওই স্লোগানদাতাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে গত ২৪ জুন ২১ জন এবং ২০ জুলাই আরও ২০ ক্যাডার কর্মকর্তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ যেন করতে না পারে সে উদ্যোগে বাধা দেন সিদ্দিক জুবায়ের।

শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, সিদ্দিক জুবায়ের একটি ‘ভয়ংকর প্ল্যানের’ অংশ হিসেবে সরকারকে তরুণ সমাজের মুখোমুখি করেছিলেন। এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত নিয়ে তিনি নানা টালবাহানা করেন। শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার প্রশাসনিক বিষয়ে দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে সিদ্দিক জুবায়ের একটি ‘ব্লান্ডার’ (ইচ্ছাকৃত ভুল) তৈরির চেষ্টা করেন। সচিবের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ। সেই সুবাদে শামীম ওসমানের সঙ্গে তার সখ্য ছিল এবং তার পরিবারের আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টিও বারবার উঠে আসে।

এদিকে বদলি বাণিজ্যের অভিযোগে বিতাড়িত সাবেক যুগ্ম সচিব (কলেজ) নুরুজ্জামানের মাধ্যমে বদলি বাণিজ্যের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন সিদ্দিক জুবায়ের। নতুন সরকার গঠনের পর দেশের প্রায় প্রতিটি কলেজে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও প্রশাসনে কর্মকর্তা পদায়নে বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠার পর নুরুজ্জামানকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। কিন্তু তার পরও তিনি ছিলেন স্বপদে। এ ছাড়া আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাদের মাউশি, এনসিটিবি, ও নায়েমে পদায়ন করতে সিদ্দিক জুবায়ের সহযোগিতা করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার একক সিদ্ধান্তে স্কুল ভর্তিতে বিতর্কিত জুলাই কোটা চালু করে পরে সমালোচনার মুখে তা সংশোধন করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের ৭০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলাকারী অধ্যাপক মালেকা আক্তার বানুকে করা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ।

উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে মঙ্গলবার সচিবালয়ে সিদ্দিক জুবায়েরের সাক্ষাৎ চেয়েও সম্ভব হয়নি। মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: